চড়ক উৎসব: সাহস না বিশ্বাস?
বাংলার অন্যতম বিস্ময়কর লোকজ উৎসব “চড়ক পূজা”। বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়, বহু মানুষের সামনে এক ব্যক্তি চক্রাকারে ঘুরছেন, অথচ তার পিঠে ঢুকানো লোহার বড়শি। এই দৃশ্য দেখে আপনি যেমন শিহরিত হন, তেমনি মনে প্রশ্নও জাগে—এই মানুষটি পড়ে যান না কেন? পিঠ ছিঁড়ে যায় না কেন? প্রচুর রক্ত তো বেরোনো উচিত ছিল!
আসুন, এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণ ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা একসাথে জেনে নিই।
পিঠ ছিঁড়ে যায় না কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে মানবদেহের গঠন এবং পেশাদার কৌশলে।
আমাদের পিঠের ত্বকের নিচে থাকে Collagen Fiber, চর্বি ও পেশি দিয়ে তৈরি একটি শক্তিশালী স্তর। এই স্তরটির আছে আশ্চর্যজনক টান সহ্য করার ক্ষমতা (Tensile Strength)—যা প্রায় ৩০০ থেকে ৫৯০ মেগাপাস্কাল পর্যন্ত হতে পারে। এটি এতটাই শক্তিশালী যে, প্রতি বর্গইঞ্চিতে কয়েক কেজি ওজনও সহজে বহন করতে পারে।
যখন লোহার হুক (বা বড়শি) ঢোকানো হয়, তখন সেটি করা হয় খুব নিখুঁতভাবে, পিঠের এমন একটি স্তরে যেটিকে বলে Fascia Layer। এটি একটি টেকসই ও নমনীয় স্তর যা গাঁট বা লিগামেন্টের মত শক্ত এবং চাপ সহ্য করতে পারদর্শী।
একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি যখন বড়শি ঢোকান, তখন তিনি হুকের অবস্থান, ঘোরার ওজন বণ্টন, টান এবং ভারসাম্য—সবকিছু একসাথে হিসাব করে নেন। ফলে চাপ নির্দিষ্ট এক জায়গায় না পড়ে পুরো পিঠে ছড়িয়ে যায়, ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রক্তপাত হয় না কেন?
রক্তপাত তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার পেছনে রয়েছে মানবদেহের রক্তবাহিক গঠন।
পিঠের যে নির্দিষ্ট জায়গায় হুক ঢোকানো হয়, সেখানে বড় কোনো রক্তনালী (Artery বা Vein) থাকে না। থাকে ছোট ছোট ক্যাপিলারি, যেগুলো ছিঁড়লেও সামান্য রক্তপাত হয় এবং তা দ্রুত জমাট বেঁধে যায়। ফলে বাইরে থেকে ব্যাপারটা ভয়াবহ মনে হলেও, আসলে ক্ষত সীমিত।
ব্যথা কেন হয় না?
এটি একধরনের মানসিক প্রস্তুতি ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার ফল।
এই প্রথায় অংশগ্রহণকারীরা অনেক আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন। তাদের মধ্যে থাকে ভক্তি, বিশ্বাস ও আত্মনিবেদন। এই মানসিক অবস্থা শরীরে Adrenaline Hormone নিঃসরণ ঘটায়, যা ব্যথা ও ভয় কমিয়ে দেয়। এর ফলে তারা ব্যথা টের পান কম, বরং একধরনের আধ্যাত্মিক ঘোরে ঢুকে পড়েন।
চড়ক প্রথার শিকড় কোথায়?
চড়ক ঘোরার এই প্রথা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। এর ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো।
একে বলা হয় Body Piercing Rituals। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে আফ্রিকায় এই ধরনের শরীর ভেদন প্রথার শুরু হয়। শুধু আফ্রিকায় নয়—মায়া, আজটেক, দ্রাবিড়, এমনকি প্রাচীন রোম-গ্রিসের মধ্যেও এই সংস্কৃতি ছিল বিদ্যমান।
- ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে থাইপুষাম উৎসবে, ভক্তরা মুরুগান দেবতার উদ্দেশ্যে জিভ, গাল, বা পিঠে ছুরি ঢোকান।
- আফ্রিকার কিছু উপজাতি ঠোঁট, কান, এমনকি নাক ভেদ করে সামাজিক পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে।
- প্রাচীন যুদ্ধযোদ্ধারাও শরীরে পিয়াসিং করত সাহস ও সামরিক পরিচয়ের চিহ্ন হিসেবে।
আজও বিশ্বের বহু জায়গায় এই প্রথাগুলো ধর্ম, সংস্কৃতি ও চেতনার সঙ্গে জড়িয়ে টিকে আছে।
এটা কি শুধু বিশ্বাস, না বিজ্ঞানের সাথেও সম্পর্ক আছে?
উত্তর হলো—দুটোই।
এটি যেমন একটি ভক্তির নিদর্শন, তেমনি এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট শারীরবৃত্তীয় কৌশল ও আন্তরিক প্রস্তুতি।
তাই চড়কের বড়শি দেখে চমকে উঠলেও, এটা বুঝে নেওয়া জরুরি—এই দৃশ্য শুধু ধর্মীয় নয়, মানবদেহের অন্যতম টেকসই কাঠামোর নিদর্শনও বটে।
আপনিও জানতে পারেন আরও অনেক কিছু!
যদি আপনি Body Piercing Rituals বিষয়টি নিয়ে আরও জানেন, Google এ “Body piercing rituals and culture” লিখে সার্চ করতে পারেন। তবে কিছু ছবি দেখতে ভয় লাগতে পারে, প্রস্তুত থাকুন!
